ফজরের নামাজের নিয়ত - ফজরের নামাজ কত রাকাত

আজকের এই পোস্টে আমরা আলোচনা করব ফজরের নামাজের নিয়ত এবং ফজরের নামাজ কয় রাকাত এই বিষয়টি নিয়ে। ফজরের নামাজের ফজিলত অনেক বেশি , ফজরের নামাজ আদায় করলে শুধুমাত্র আখিরাতেই নয় দুনিয়াতেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৌভাগ্য লাভ করা যায়। তাই চলুন আজকে ফজরের নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

আমাদের মধ্যে অনেকেই এমন মানুষ রয়েছেন যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন ঠিকই কিন্তু বিভিন্ন নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানেন না , আর এই বিষয়টি জানানোর জন্যই আজকে আপনাদের সাথে আলোচনা করব ফজরের নামাজের নিয়ত , ফজরের নামাজ কয় রাকাত , ফজরের নামাজ না পড়ার শাস্তি এবং ফজরের নামাজের ইতিহাস ও ফজরের নামাজের ফজিলত নিয়ে। ফজরের নামাজ পড়ার ফজিলত অনেক বেশি এবং ফজরের নামাজ না পড়ার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। তাই চলুন আর দেরি না করে ফজরের নামাজ না পড়লে কিরূপ শাস্তি হতে পারে এবং ফজরের নামাজ পড়ার ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

সূচিপত্রঃ ফজরের নামাজের নিয়ত - ফজরের নামাজ কত রাকাত

ফজরের নামাজের ইতিহাস

আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন না ফজরের নামাজের ইতিহাস সম্পর্কে। সর্বপ্রথম কে এই নামাজ পড়েছিল এবং কি কারণে তিনি ফজরের নামাজ পড়েছিলেন সেই সম্পর্কে আজকে আপনাদেরকে বিস্তারিত জানাবো। যারা ফজরের নামাজের ইতিহাস জানেন না তারা অবশ্যই এই বিষয়টি জেনে রাখুন।

আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বেহেশত থেকে এ দুনিয়ায় সরণ দ্বীপে তথা লঙ্কা দ্বীপের পর্বত চূড়ায় নির্বাসিত হন তখন একদিকে ছিল রাত্রির ঘোর অন্ধকার, অপর দিকে ছিল শ্বাপদ কূলের ভয়। পশুকুলে তাঁকে খাবার জন্য লাঙ্গুল আছাড়ি, মুখ ব্যাদন করে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে তিনি এদের থেকে বাঁচবার জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে আশ্রয় চেয়ে প্রথমে এক রাকাত নামায পড়তে গিয়ে সিজদায় পড়ে যান। পরে যখন অন্ধকার কেটে পূর্বদিন ফর্সা হয়ে এলো, শ্বাপদকূলও স্ব-স্ব স্থানে লুকিয়ে পড়লো, তখন আল্লাহ তাআলার শোকরিয়া স্বরূপ আরো এক রাকাত নামাজ আদায় করলেন। 
পরবর্তীকালে উম্মতে মুহাম্মাদী তথা আমাদের উপর ২৭রজব মেরাজের রাত্রিতে এ নামাজ ফরজ হয়। হযরত আদম (আঃ) লঙ্কাদ্বীপের যে পর্বত চূড়ায় অবতীর্ণ হন, পরবর্তীকালে ঐ পর্বতের চূড়ার নাম রাখা হয় "আদমপীক বা আদম পাহাড়" এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আল্লাহ তায়ালা আদি মাতা হযরত হাওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরব দেশের আরাফাতের ময়দানে অবতীর্ণ করে। দু'জন দু'দেশ থেকে আল্লাহর কান্নাকাটি করতে থাকেন। সাড়ে তিনশত বছর কান্নাকাটি ও আরাধনা করার পর আল্লাহ তায়ালা খুশী হয়ে হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর সাহায্যে উভয়ের মিলন ঘটিয়ে দেন। লঙ্কাদ্বীপের যে পাহাড়ে হযরত আদম (আঃ) সেজদায় পড়ে কেঁদে ছিলেন, সে পাহাড়ে তাঁর চক্ষের পানিতে দু'টি ফোঁয়ারা বা ঝরণার সৃষ্টি হয়েছে যা অদ্যাবধি প্রবাহিত হয়ে আসছে।

ফজরের নামাজের ফজিলত

আপনারা কি ফজরের নামাজের ফজিলত কত তা জানেন ? অনেক মানুষই ফজরের নামাজের ফজিলত সম্পর্কে জানেনা। তাই আজকে আপনাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ফজরের নামাজের ফজিলত সম্পর্কে জানাবো। ফজরের নামাজ আদায় করা অনেক বেশি এবং ফজরের নামাজের মাধ্যমে দুনিয়াবী কাজেও সৌভাগ্য লাভ করা যায়।

মুসলিম শরীফের একটি হাদিসে বর্ণনা করা রয়েছে -যথাযথ নিয়মে যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করে ,সেদিন ওই ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মায় চলে যায়।আসমান এবং জমিন অর্থাৎ দুনিয়া এবং আখিরাতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু হলো ফজরের দুই রাকাত নামাজ (তিরমিজি - ২১৮৪)।

নবীজি (সা) বলেছেন- যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার নামাজ পড়লো সে যেন অর্ধেক রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করলো এবং যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সাথে করল সে যেন পুরো রাত্রি জেগে আল্লাহর ইবাদত করলো।

বুরাইদা আল আসলামি (রা) এর বর্ণনা থেকে জানতে পারা যায় মহানবী (সা) বলেছেন - যারা ফজরের নামাজ এর সময় মসজিদের দিকে নামাজের উদ্দেশ্যে যাই , কেয়ামতের দিন তাদেরকে সম্পূর্ণ নোট প্রাপ্তির সুসংবাদ দেয়া হবে ( আবু দাউদ - ৪৯৪)

হযরত আবু জুহাইর উমরা ইবনে রুয়াইবা (রা) থেকে জানতে পারা যায় যে নবীজি বলেছেন - সে ব্যক্তি কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না যে ব্যক্তি সূর্যদয় এবং সূর্যাস্তের আগে ফজর ও আসরের নামাজ আদায় করব ( মুসলিম শরীফ- ৬৩৪)

মহানবী (সা) বলেছেন - যারা ফজর এবং এশার নামাজে গাফিলতি করে বা ফজর এবং এশার নামাজ বাদ দেয় তারা হলো মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত। মোনাফিকদের কাছে ফজল এবং এশার নামাজ এর মতন ভারী কোন নামাজ নেই। নবীজি আরও বলেন তারা যদি ফজর এবং এশার নামাজের ফজিলত সম্পর্কে জানতো তাহলে তারা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও নামাজের জন্য মসজিদে আসতো (বুখারি শরীফ ৬৫৭)।

সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই যারা নামাজ আদায় করে অর্থাৎ ফজরের নামাজ এবং আসরের নামাজ যারা সময় মতন আদায় করে তারা চাঁদের মতন ভাবে আল্লাহ পাকের সাক্ষাৎ পাবে অর্থাৎ তা যেখানেই থাকি বা যত ভিড়েই থাকি না কেন চাঁদ দেখতে যেমন আমাদের কোন অসুবিধা হয় না ঠিক তেমন ভাবেই এই দুই নামাজ আদায়কারী আল্লাহ পাকের সাক্ষাৎ পাবেন। এই প্রসঙ্গে জারির বিন আব্দুল্লাহ (রা) থেকে জানতে পারা যায় যে নবীজি বলেছেন - ওই চাঁদকে তোমরা যেমন ভাবে দেখতে পাচ্ছ ঠিক তেমনিভাবে অচিরেই তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে ( সূরা কাহাফ ,আয়াত ৩৯)।

আরো পড়ুনঃ খতমে তাসমিয়া কাকে বলে এবং খতমে তাসমিয়া পড়ার নিয়ম

প্রতিদিন দুইটি সময়ে ফেরেশতাদের পালা বদল হয় একটি হলো ফজর এর সময় এবং অপরটির আসরের সময় এবং এই ফেরেস্তাগুলোকে আল্লাহপাক জিজ্ঞেস করেন আমাকে কি অবস্থায় রেখে এসেছো ? এর উত্তরে ফেরেশতাগণ বলেন তারা আল্লাহর বান্দাদের নামাজরত অবস্থায় রেখে এসেছেন সুতরাং যারা সময় মতন ফজরের নামাজ আদায় করে তাদের জন্য ফেরেশতারা আল্লাহ পাকের কাছে সাক্ষী দিয়ে থাকে ( বুখারী ও মুসলিম শরীফ)।

ফজরের নামাজ সঠিক সময় আদায় করলে রোজগারের বরকত আসে এবং রিজিকের অভাব দূর হয় কেননা ফজরের এই সময় রিজিক বন্টনের সময়। এছাড়াও ফজরের নামাজ আদায়কারীদের মন প্রফুল্ল থাকে ( সহীহ বুখারী , মুসলিম শরীফ) এবং অলসতা দূর হয় ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

ফজরের নামাজ কত রাকাত

ফজরের নামাজের ইতিহাস এবং ফজরের নামাজের ফজিলত জানার পরে এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক ফজরের নামাজ কয় রাকাত। আপনারা অনেকেই স্পষ্ট ভাবে জানতে চেয়ে থাকেন ফজরের নামাজ কত রাকাত। সুবহে সাদিকের পর থেকে  সূর্য উদয় না হওয়া পর্যন্ত ফজরের নামাজের সময়। নামাজ মোট ৪ রাকাত । ফজরের এই চার রাকাত নামাজের মধ্যে ২ রাকাত সুন্নত এবং ২ রাকায়ত ফরজ। আশা করি ফজরের নামাজ কত রাকাত তা জানতে পেরেছেন। 

ফজরের নামাজের নিয়ত

এবার আপনাদেরকে জানাবো ফজরের নামাজের নিয়ত সংখ্যা । আপনারা সবাই জানেন বা উপরের অংশ জেনেছেন ফজরের নামাজ মোট চার রাকাত যার ভেতরে দুই রাকাত সুন্নত এবং দুই রাকাত ফরজ নামাজ রয়েছে। ফজরের নামাজের সুন্নত এবং ফরজ নামাজের নিয়ত গুলো নিচে তুলে ধরা হলো বাংলা উচ্চারণ সহ।

২ রাকায়াত সন্নত নামাজের নিয়তঃ نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ لِلَّهِ تَعَا لَى رَكْعَتَىْ صَلَوةِ الْفَجْرِ سُنَّةُ رَسُوْلُ للَّهِ تَعَا لَى مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِ يْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَرُ-

উচ্চারণঃ নাওয়াইতুয়ান উসাল্লিয়া লিল্লাহ তাআলা রাকায়াতাই ছালাতিল ফজরে সুন্নাতু রাসুলুল্লাহি তায়ালা মোতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবর।"
২ রাকাত ফরজ নামাজের নিয়তঃ نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ لِلَّهِ تَعَا لَى رَكْعَتَىْ صَلَوةِ الْفَجْرِ فَرْضُ للَّهِ تَعَا لَى مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِ يْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَرُ

উচ্চারণঃ নাওয়াইতুয়ান উসাল্লিয়া লিল্লাহ তাআলা রাকায়াতাই ছালাতিল ফজরে ফারযুল্লাহি রাসুলুল্লাহি তায়ালা মোতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবর।"

ফজরের নামাজ না পড়ার শাস্তি

যারা ফজরের নামাজ আদায় না করা অত্যন্ত গুনাহের একটি কাজ এবং যারা এই কাজটি করে তাদেরকে অবশ্যই কঠিন আজাবে সম্মুখীন হতে হবে। যারা ফজরের নামাজ আদায় করে না তাদের ফজরের নামাজ না পড়ার শাস্তি হিসেবে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। আল্লাহ পাক আমাদের উপরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন এর মধ্যে থেকে যেকোনো এক ওয়াক্ত নামাজ যদি আমরা না পড়ি বা অবহেলায় কাটিয়ে দিই তাহলে সে ক্ষেত্রে বেনামাজিদের কাতারে চলে যাব। এক হাদিসে  নবীজির এরশাদ করেন -মুমিন এবং কাফেরদের মধ্যে ব্যবধান নামাজের , আর যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে দিল সে কাফের হয়ে গেল ( তিরমিজি ২৬২১)

আরো পড়ুনঃ সূরা কাহাফ এর ফজিলত

যেই ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ফজরের নামাজ বাদ দেয় তার উপর থেকে আল্লাহ পাক রহমত তুলে নেন এবং সেই ব্যক্তিকে আল্লাহপাক তার জিম্মাদারী থেকে বের করে দেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ বাদ দেয় তার উপরে আল্লাহ পাকের কোন জিম্মাদারী থাকে না। বুখারী শরীফের একটি হাদিস থেকে জানতে পারা যায় যে নবীজি বলেছেন - মোনাফেকদের কাছে ফজর এবং এশার নামাজ নামাজের মতন ভারী কোন নামাজ নেই এবং যারা এই দুই ওয়াক্তের নামাজ বাদ দেয় তারা মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত। আর মোনাফিকদের শাস্তি হিসেবে - তাদেরকে মাথা নিচের দিকে এবং পা উপরের দিকে রাখা অবস্থায় জাহান্নামের ফেরেশতাগণ এদেরকে আগুনের গদা দিয়ে আঘাত করতে থাকবে।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) মিরাজে গিয়ে একদল লোক দেখতে পান , ,যাদেরকে ফেরেশতাগণ পাথর দ্বারা আঘাত করে তাদের মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ করছিল এবং সাথে সাথে আবার সেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করা মাথাগুলো পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল এবং পুনরায় ফেরেশতাগণ একইভাবে তাদের মাথা পূর্ণ করছিল। এই ঘটনা দেখে রাসুলুল্লাহ (সা) জিব্রাইল ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলেন এরা কোন সম্প্রদায়ের লোক এবং কি অপরাধে তাদের এই রূপ শাস্তি হচ্ছে ? এর উত্তরে জিব্রাইল (আ) নবীজিকে জানান - এগুলো আপনারই উম্মত এর মধ্যে একদল যারা নামাজের সময় ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল এবং নামাজের সময় নিদ্রায় অতিবাহিত করত ও অলসতা করে নামাজ ত্যাগ করত তারা এই শাস্তি ভোগ করছে। সুতরাং ফজরের নামাজ আদায় না করার শাস্তি কিরুপ হতে পারে আশা করছি আপনারা বুঝতে পারছেন।

মন্তব্য, আজকের আলোচনায় আপনাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছি ফজরের নামাজের নিয়ত এবং ফজরের নামাজ কয় রাকাত এই বিষয়ে এবং এর পাশাপাশি আপনারা জানতে পেরেছেন ফজরের নামাজের ফজিলত এবং ফজরের নামাজ না পড়ার শাস্তি সম্পর্কে। ফজরের নামাজের ফজিলত অনেক বেশি তাই কখনোই আমাদের উচিত নয় ফজরের নামাজ ত্যাগ করা। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার তৌফিক নসিব করুন (আমিন)।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন

comment url