রোজা ও ইফতারের ফজিলত - রোজা নষ্ট ও মাখরুহের কারন

মুসলিম উম্মাহের জন্য রমজান মাস একটি মর্যাদা সম্পন্ন এবং পবিত্র মাস। এই মাস আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাস। রমজানের একমাস রোজা পালনের এবং বিভিন্ন ইবাদতের মধ্যে দিয়ে নিজের গুনাহ মাফ করার শ্রেষ্ঠ একটি মাস, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন-যে ব্যাক্তি রমজান মাস পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করতে পারল না সেই ব্যক্তির মতন অভাগা আর নেই (তিরমিজি শরীফ)।

এই পোষ্টের মাধ্যমে আজকে আপনাদের সাথে আলোচনা করব রোজা, ইফতার , সেহেরী এবং রোজার ফজিলত, সেহেরী এবং ইফতারের ফজিলত সম্পর্কে। রোজার সম্পর্কে আপনার অজানা তথ্যগুলো এই পোস্ট থেকে জেনে নিন।

রোজা সম্পর্কে এই পোস্টে যা যা থাকছেঃ রোজা - রোজা ও ইফতারের নিয়ত - রোজা ও ইফতারের ফজিলত - রোজা নষ্ট ও মাকরুহের কারণসমূহ

রোজা 

ইসলামে চন্দ্র বছরের নবম মাসের নাম হল রমজান। আর এই রমজান মাসে প্রথম তারিখ হতে শেষ তারিখ পর্যন্ত প্রত্যেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, আল্লাহর হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে সকল প্রকার পানাহার ,স্ত্রী সঙ্গম, সকল প্রকার খারাপ কাজ থাকাকে বিরত থাকাকে 'রোজা' বলে। রোজা হল ইসলামের তৃতীয় রোকন বা ভিত্তি। রোজার মাধ্যমে দুঃখী ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের দুঃখ কষ্ট কিছুটা হলেও অনুভব করা যায়। রোজা মানুষকে ধৈর্য ও আত্মসমজমে শিক্ষা দেয়। রমজানের এই একমাস রোজা উম্মতে মুহাম্মদীর উপরে আল্লাহ পাক ফরজ করেছেন ।

কাদের উপর রোজা ফরজ ও কাদের উপর নয়

প্রাপ্তবয়স্ক , সুস্থ , সজ্ঞান সকল মুসলমান নর-নারীর উপর রমজানের এই ৩০ টি রোজা ফরজ। প্রাপ্তবয়স্ক , সুস্থ ,সজ্ঞান হওয়া সত্বেও যদি কেউ রমজানের এই ৩০ টি রোজা পালন না করে তাহলে তাকে গুনাগার হতে হবে । আর কেউ যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক বা নাবালক হয় কিংবা গুরুতরভাবে পীড়িত বা অসুস্থ হয় , মুসাফির হয় এবং কেউ যদি পাগল হয় তাহলে তাদের উপরে রোজা ফরজ নয়। কিন্তু অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পরে এবং মুসাকে মুকিম হওয়ার পরে কাজা রোজা গুলো পূরণ করবে। যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে মুসাফির অবস্থাতেও রোজা করা জায়েজ।

এছাড়াও ,গর্ভবতী , স্তন দানকারী মা যে নাকি রোজা করলে বাচ্চার অসুবিধা হতে পারে, মেয়েদের সব অবস্থায় রোজা ছেড়ে দিতে পারে। এবং এদেরকে পরবর্তীতে সুস্থ হলে এই কাজা রোজা গুলো করে নিতে হবে হবে। মৃত ব্যক্তির যদি কোন কাজা রোজা থাকে তবে সেগুলো ওয়ারিশদের অর্ডার করে দেওয়া ওয়াজিব।

যে সকল কারণে রোজা ভঙ্গ হয়

রোজা ভঙ্গ হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে, আসুন এবার আমরা তাহলে জেনে নি রোজা ভঙ্গের কারণ গুলি,

  • জোর করে কেউ কিছু খাওয়ে দিলে
  • ওযু করার সময় কন্ঠনালীতে পানি প্রবেশ করালে
  • নাক দ্বারা পানি মাথা পর্যন্ত টেনে নিলি
  • কানের ভেতরে তেল দিলে
  • পেটের কিংবা মাথার কোন যখন লাগালে যদি ওটা ভেতরে চলে যায় তাহলে
  • সময় হয়ে গেছে মনে করে আগে ইফতার করলে
  • ঘুমন্ত অবস্থায় গলার ভিতরে কোন কিছু প্রবেশ করলে
  • যৌন মিলন করলে
  • ভুলে কিছু খাওয়ার পরে রোজা ভঙ্গ হয়েছে বলে ইফতার করলে
  • প্রস্রাব পায়খানা দ্বার দিয়ে কোন কিছু প্রবেশ করালে
  • ধূমপান করলে
  • ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় বমি করলে
  • কোন স্থান কেটে গেলে সেই জায়গা দিয়ে বেশি পরিমাণে রক্ত বের হলে

যে যে কারণে রোজা নষ্ট হয় না

বেশ অনেকগুলো কারণ আছে যেগুলো করলে আমরা মনে করি রোজা নষ্ট বা ভেঙ্গে যায় কিন্তু আসলে এগুলো করলে রোজা নষ্ট হয় না। চলুন তাহলে যাক কোন কোন কারণ গুলোতে রোজা নষ্ট হয় না,

  • রোজা থাকা, অবস্থায় রোজার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে কোন কিছু খেলে অথব রোজা রেখে ভুলে গিয়ে স্ত্রী সঙ্গম করলে। যখনই মনে হবে তখনই দেরি না করে এই কাজগুলো বন্ধ করে দিতে।
  • হবে শরীরের তেল মালিশ করলে রোজা ভঙ্গ হয় না
  • চোখে সুরমা ও শরীরে যে কোন প্রকার সুগন্ধি ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হয় না
  • পরনিন্দা বা গীবত করলে রোজা ভঙ্গ হয় না, কিন্তু রোজা রেখে গীবত বা পরনিন্দা না করাই ভালো
  • মেসওয়াক করলে
  • কানে পানি প্রবেশ করলে রোজা ভঙ্গ হয় না
  • স্ত্রী আলিঙ্গন ও স্ত্রীকে চুমু দেলে

রোজা মাকরুহের কারণ

রোজা মাখরুহের কারণ গুলো নিচে দেওয়া হল,
  • কোন জিনিস স্বাদ গ্রহণ করলে
  • গীবত করলে
  • রোজা রেখেছে বলে একেবারে চুপ থাকলে
  • বিনা প্রয়োজনে নাকে পানি দিলে
  • টুথপেষ্ট বা পাউডার দিয়ে দাঁত ব্রাশ করলে
  • পানিতে নেমে বায়ু ছাড়লে
  • বেশিরভাগ সময় যাকে তাকে গালাগালি করলে
  • গরমের কারণে ভেজা কাপড় শরীরে জড়িয়ে রাখলে
  • বিনা প্রয়োজনে বারবার কুলি করলে
  • বিনা প্রয়োজনে কিছু চাবালে
  • স্বপ্নদোষ হলে বা কোন নারীকে দেখে বীর্যপাত হলে রোজা ভঙ্গ হয় না

রোজা সম্পর্কে আল্লাহর বাণী

রোজা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন - হে মুমিনগন তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর।

আল্লাহ পাক আরো বলেন - তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রমজানকে পায় , সে যেন রোজা রাখে। এখান থেকে বোঝা ,যায় যে রমজানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস।

রমজানের শ্রেষ্ঠত্ব উল্লেখ করে কুরআন মাজীদে আল্লাহপাক বলেন - রমজান মাস! মানবজাতির পথ নির্দেশ ও হেদায়েত বিষয়ক নিদর্শন নিয়ে কুরআন নাজিল হয়েছে যা, সত্যকে মিথ্যা হতে পৃথক করে।

আল্লাহ পাক বলেছেন - যে বান্দাকে ভুল আমার জন্যই রোজা রাখে, তার রোজার প্রতিদান আমি নিজে তাকে দেব ।

রোজা সম্পর্কিত হাদিস

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-যখন রমজান মাস আরম্ভ হয় তখন থেকে বেহেস্তের দরজা গুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি আরো বলেন রমজান মাস আসলে শয়তানদেরকে শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়।

রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন - রমজানের প্রতি রাত্রে কয়েক লক্ষ মানুষকে দুচোখ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়

রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন - রোজা সবরের অর্ধেক, আর সবর হল ইসলামের অর্ধেক।

একটি হাদিস থেকে পাওয়া যায়, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন - রোজাদারের ঘুম ও এবাদত হিসেবে গণ্য হয়।

হযরত আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-৩ তিন ধরনের মানুষে কবর থেকে ওঠা মাত্র আল্লাহ ফেরেশতারা তাদের সাথে মুসাফা করবেন, এরা হলো শহীদ , রমজানে পুরা মাস রোজা কারী  এবং আরাফাত দিনে রোজা পালন ।

রাসূলুল্লাহ (স) বলেন-রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয়।

রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন-রোজা হল মুসলমানদের ঢাল স্বরুপ। তোমাদের মধ্যে রোজা রাখিয়া কেউ যেন মন্দ কথা না বলে কেউ যেন কলহ ,বিবাদ না করে । অন্য কেউ যদি কল হয়ে লিপ্ত হতে আসে তাহলে তাকে বলে দিও ,আমি রোজা রোজাদার।


রমজানের ফজিলত

রমজান হল পবিত্র মাস এবং এবাদতের জন্য শ্রেষ্ঠ মাস। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে মর্যাদা এবং ফজিলত অনেক বেশি। এই মাসে এমন একটি রাত আছে যে রাতটিকে বলা হয় হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসের ফজিলত বলে শেষ করার মতো নয়। হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-পবিত্র রমজান উপলক্ষে আমার উম্মতকে পাঁচটি বিষয়ে দান করা হয়েছে, যা এর আগে অন্য কোন উম্মতকে প্রদান করা হয়নি।

রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মৃগনাভী অপেক্ষা অধিক প্রিয়। রমজান মাসে রোজাদারদের জন্য সমুদ্রের মাছ গুলো ইফতার পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে। রমজানের প্রথম ১০ দিন রহমতের, দ্বিতীয় দশ দিন মাগফিরাতের এবং তৃতীয় দশ দিন নাজাতের। রমজানের শেষ রাতে রোজা তাদের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। রমজান মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিকল বেঁধে রাখা হয়, এর ফলে অন্যান্য মাসে শয়তান কিভাবে মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারে এ মাসে সেভাবে পারে না। রমজান মাস হল দোয়া কবুলের মাস, জাহান্নাম নাম থেকে মুক্তির, সংযমের মাস।

এক হাদিসে বর্ণিত আছে -একদিন হযরত মূসা (আ) আল্লাহর কাছে জানতে চাইবেন যে, উম্মতের মোহাম্মদ এর জন্য কোন মাসকে বেশি ফজিলতের মাস হিসেবে নির্ধারণ করা  হয়েছে ? আল্লাহ পাক তখন বলেন -রমজান মাসকে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দান করা হয়েছে। তখন মুসা (আ) আরও জানতে চাইল, এই মাসের ফজিলত কেমন হবে? এর উত্তরে আল্লাহতালা বলেন - তোমাদের সাধারণ মানুষের তুলনায় আমার মর্যাদা যেমন, অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে মর্যাদা সেরকম। এর দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায়, রমজান মাসের ফজিলত এবং মর্যাদা কতটা।

সেহেরী ফজিলত

সেহেরী খাওয়া সুন্নত, তাকওয়া অর্জন করার জন্য সেহরি খাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -তোমরা রোজা রাখার পূর্বে সেহেরী খাও, কেননা সেহেরীতে রয়েছে বরকত। নবীজি (স) আরো বলেন, এক লোকমা খাবার অথবা এক ঢোক পানি হলেও তোমরা সেহেরী খাও। সেই দিন সময় একটি বরকতময় সময়, এই সময় দোয়া কবুল হয়। সেহেরী খাওয়ার মাধ্যমে আমরা নবীজির সুন্নত পালন করার সুযোগ পাই, সেহরি খাওয়ার ফলে আপনাদের শরীর সারাদিন না খেয়ে থাকার শক্তি অর্জন করতে পারে। রাসূল (স) রোজা রাখার পূর্বে কখনো সেহেরী ছেড়ে দিতেন, এবং সেহরি খাওয়ার জন্য তিনি সাহাবীদের কেউ তাগিদ দিতেন । সেহেরির প্রতি লোকমা খাবারের বিনিময়ে আল্লাহ পাক বান্দাদের পূর্ণ দান করে থাকেন।

কোন খাবার দিয়ে ইফতার শুরু করা সুন্নত

রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন -তোমরা প্রথমে খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করুন, খেজুর না থাকলে পানি দিয়ে ইফতার শুরু করুন কারণ পানি পবিত্র। খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা সুন্নত। আর খেজুর না থাকলে পানি দিয়ে ইফতার শুরু করতে হয় । খুরমা বা খেজুর না থাকলে মিষ্টি জাতীয় কোন কিছু দিয়ে ইফতার শুরু করা উচিত ।


কাউকে ইফতার করানোর ফজিলত

রোজা রাখা যেমন ছোয়াবের কাজ, অন্যদিকে কাউকে রোজা খোলা বা ইফতার করানোর অত্যন্ত পণ্যের কাজ। কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন রোজাদারকে ইফতার করায় তবে সে ওই রোজাদারের সমান সব পাবে এবং এতে রোজাদারদের সওয়াব হতে সামান্য কিছু কম হতো না।

এক হাদিসে রাসূল (স) বলেছেন - যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোন রোজাদার ব্যক্তিকে ইফতার করায় ,তবে সেই ইফতার করানো তার গুনাহ মোচন ও জাহান্নাম হতে মুক্তির কারণ হবে।

অপর একটি হাদিস থেকে পাওয়া যায় -যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে একটি খেজুর কিংবা এক গ্লাস পানি অথবা কিছু শরবত দ্বারা ইফতার করায় তবে এই ইফতার তার পাপ মোচনের কারণ হবে। ইফতারের সময় দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়। হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত , রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন - তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল না করে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না ন্যায় বিচারক,ইফতর করার আগে রোজাদার ব্যক্তির দোয়া,নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া (মুসনাদে আহমদঃ৯৭৪২)। রোজাদারকে ইফতার করানোর মধ্যে অনেক বরকত নেয়ামত রয়েছে। ফেরেশতারা ইফতারের সময় রোজাদারদের জন্য রহমত কামনা করে।

শেষ কথা, রোজা এবং রমজান মাসের ফজিলত সম্পর্কে আলোচনার পরে এটাই বলতে হয় যে , এই মাসটি আমাদের ইবাদত বন্দেগী দানসদকা এবং বিভিন্ন ভালো কাজের মাধ্যমে কাটানো উচিত। কারণ এই মাসে ইবাদত বন্দেগীতে অন্যান্য মাসে তুলনায় অনেক বেশি সব পাওয়া যায়, তাই এই মাসটিকে অবহেলায় না কাটিয়ে আমাদের উচিত, অতীতের গুনাহ গুলোর জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা। এই মাসে দোয়া কবুলের মাস , আর এই মাসে রোজাদারদের দোয়া আল্লাহ কবুল না করে ফিরিয়ে দেয় না তাই আমাদের উচিত  তওবা, দোয়া - দরুদ, নামাজ কালাম এবং বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগির মধ্যে দিয়ে মাসকে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url