শবে বরাত ব লাইলাতুল বরাত হলো মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব গুলোর মধ্যে একটি। এই
পবিত্র রাতটি ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে কাটানো অতান্ত ফজিলতপূর্ণ। শবে বরাতের এই
পবিত্র রাতকে ভাগ্য রজনীয় বলা হয়ে থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এ রাত উৎযাপন করতে
গিয়ে যেনে কোন ধরনের বেদয়াত না হয়ে যায়।
শবে বরাতকে পবিত্র রাত হিসেবে জানলেও অনেকেই হয়তে এই রাতের ফজিলত সম্পর্কে
বিস্তারিত জানেন না ,তাই আজ আপনাদেরকে সংক্ষেপে এই রাতের ফজিলত জানানোর চেষ্টা
করবো এবং এ রাতের রাকায়ত সংখ্যা ও শবে বরাতের নামাজ নফল না সন্নত সেটাও
স্পস্টভাবে জানীয়া দেবো।
'লাইলাতুল বারাত' অর্থ ভাগ্য রজনী। অন্য কথায় একে শবে বরাত বলা হয়। এই রাত্রে
গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ধর্মীয় ভাষা ফজিলত অন্যান্য মাসের থেকে কম নয়।
অধিকন্তু কোন কোন বুজুর্গান ও মাশায়েখগণের মতে অত্যাধিক। কারণ স্বরূপ তারা এ কথা
বলেছেন যে, এই মাসের ১৪ দিবাগত রাত সৃষ্টিকুলের হায়াত মউত, রিজিক, দৌলত, উন্নতি
অবনতি, সুখ দুঃখ, উঠান পতন, ভালো মন্দ, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি আগামী এক বছরের জন্য
লিপি বদ্ধ করা হয়। একমাত্র 'লাইলাতুল ক্বদর' ব্যতীত এর সমতুল্য কোন মাস নেই। তাই
সহজেই অনুমান করা যায় যে এ মাসের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য তথা ফজিলত ও বুজুর্গ
অত্যন্ত বেশি।
এ রাতটির সম্মান ও কদর করতে হলে আমাদের প্রত্যেক মুসলমান মুমিনদের একান্ত উচিত
সন্ধ্যা থেকে সুবেহ সাদিক পর্যন্ত সারারাত ইবাদত বন্দেগীর তথা কোরআন তিলাওয়াত,
তসবীহ তাহলীল ও তওবা এস্তেগফার, দোয়া-দরুদ এবং নফল নামাজের মাধ্যমে কাটিয়ে দেওয়া।
গরীব মিসকীনদের দান খয়রাত করা, তাদিগকে ভোজে আপ্যায়িত করা ইত্যাদি ইবাদতের
সামিল। এতে অত্যাধিক সওয়াব হাসিল হয় এবং দোযখের কঠিন আজাব থেকে রক্ষা পাওয়া
যায়।
কিন্তু ইবাদতের নামে হিন্দুদের দেওয়ালি উৎসবের ন্যায় সূরা এ রাতে অসংখ্য
মোমবাতি ও ব্যয়বহুল মশাল জ্বালিয়ে উৎসব করা একে অন্যের গায়ের রং ছিটিয়ে
আমোদ উৎসব করাও সম্পূর্ণরূপে ইসলাম ধর্ম বিরোধী কাজ এবং অপব্যয়। কুরআন পাকে
আছে, " আল্লাহ তায়ালা অপব্যাকে পছন্দ করেন না" আর এতে প্রশস্ত হয়ে যায়
জাহান্নামে যাওয়ার রাস্তা। আর এসব কার্যকলাপ হচ্ছে বেদাত। 'আনিসুল ওয়ায়েজীন'
কিতাবে নবী করীম (সাঃ) এর বাণী উদ্ধৃত আছেঃ নতুন যে কোন প্রথা বলতেই বেদাত। আর
বেদাত বলতে গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা এবং সকল প্রকার পথভ্রষ্টতায় জাহান্নামের পথ
প্রদর্শক। শবে বরাতের ফজিলত সম্বন্ধে বিভিন্ন কিতাবে বহু বর্ণনা দেওয়া আছে।
আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত আছেঃ রাসূলে আকরাম (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ হে
বিশ্ববাসীর বান্দাগণ! তোমরা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত্রে নিদ্রা প্রতি
পরিত্যাগ করেঃ ইবাদতে লিপ্ত হও। কেননা এই রাত্রে অত্যন্ত ফজিলত বরকতময় এ
রাত্রে আল্লাহ তায়া'লা ঘোষণা করেন "তোমাদের মধ্যে কেউ কি ক্ষমাপ্রার্থনাকারী
আছে? আমি অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দিব।" হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, নবী পাক (সাঃ)
এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি জাহান্নামের কঠোর আযাব থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই, সে যেন
শাবান মাসের ১৫ তারিখে রাত্রে এবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকে।
তাহলে করুণাময় আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের অগ্নি হারাম করে দিবেন। হাদিস
শরীফে আরো আছে প্রিয় নবী হযরত রসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই শাবান
মাসের ১৫ তারিখের রাত্রে (ইবাদতকারীকে) আল্লাহ তায়ালা বনী কালব, বনী রবী ও বনি
মুদার গোত্রের ভেড়া ও বকরির পশমের সংখ্যা পরিমাণ গুণাগার উম্মতের পাপ রাশী
ক্ষমা করে দেন। কথিত আছে যে, আরবের এই তিনটি বিখ্যাত গোত্রের প্রত্যেকটি গোত্র
থেকে তিন হাজার থেকে চার হাজারের মতো ভেড়া বকরি পালন করতো। আমাদের প্রিয় নবী
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এরশাদ করেছেন যে ব্যাক্তি ১৫ শাবানের রাতটিকে জীবিত রাখবে
অর্থাৎ নিদ্রা ও আলস্য ত্যাগ করে ইবাদত বন্দেগীতে মগ্ন থাকবে, পরম করুনাময়
আল্লাহ তায়ালা তাকে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত জীবিত রাখবেন। (অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও
তার আমলনামায় সওয়াব লেখা হতে থাকবে।)
অন্য এক রেয়ায়েতে আরো বর্ণিত আছেঃ বিশ্বনবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি
শা'বান মাসের ১৫ তারিখে রোযা রাখবে দো্যখের অগ্নি তাকে স্পর্শ করবে না। অপর
হাদিস শরীফে উল্লেখ আছেঃ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ
হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে উপদেশ দিয়েছেন যে, আপনার উম্মতগণ যেন শবে বরাতকে
জিন্দা রাখে, তাহলে শবে কদরকেও জিন্দা রাখা হবে। (অর্থাৎ শ'বে কদরের সমপরিমান
পূন্য অর্জণ করা হবে) হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত আছে, নবী পাক (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ
করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ১৫শা'বানের রাত্রিতে ইবাদতকারী বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।
কিন্তু শরাবী, যেনাকার (পুরুষ স্ত্রী), মাতা-পিতার অবাধ্য ও কষ্ট প্রদানকারী,
গণ, সুদখোর, যাদুকর, কৃপণ ইত্যাদিকে ক্ষমা করবেন না। (তবে হ্যাঁ, এসব ব্যক্তি
খালেছ দিলে তওবা করলে ক্ষমা পাওয়ার আশা করা যায়।)
কেননা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ঘোষণা করেছেনঃ উচ্চারণঃ কুল ইয়া ই'বা দিইয়াল্লাযিনা
আছরাফু আ'লা আনফুছিহিম লা তাক্বনাতু মিররাহমাতিল্লাহে। ইন্নালাহা ইয়াগফেরুয
যুনুবা জামীআ', ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহীম। অর্থঃ বল, হে আমার বান্দাগণ! তোমারা
যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ তারা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না; আল্লাহ
(তোমাদের) সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা ঝুমার
আয়াত নং- ৫৩) আরো একটি হাদীস শরীফে আছেঃ বিশ্বনবী (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ একদা
জিবরাইল (আঃ) এসে আমাকে বললেন, ' হে আল্লাহর হাবিব (সাঃ)! আপনি বিছানা ছেড়ে উঠুন
এবং আল্লাহ পাকের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আল্লাহ তায়ালা এ রাত্রে (১৫
শাবানের রাত্র) স্বীয় বান্দাদের জন্য একশত রহমতের দরজা খুলে দেন অতএব আপনি এ
বুজুর্গ রাত্রে স্বীয় উম্মতগণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
কিন্তু মোশরেক, শরাবখোর, সুদখোর, ঘুষখোর, যেনাকার, গণক, যাদুকর, বখীল ইত্যাদির
জন্য প্রার্থনা করবেন না। কারন আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না, এদের জাহান্নামে
কঠিন আযাবে নিমজ্জিত থাকবে। এ মাসে (শা'বান মাসে) রমযানে মাসের রোযা রাখার
প্রস্তুতি হিসেবে কমসে কম তিনটি রোযা রাখবে। ১৩,১৪,১৫ তারিখ অথবা ১৪, ১৫, ১৬
তারিখ: তা হলে ইহুদীদের বিরুদ্ধাচরণ করা হবে। তারা মাত্র একটি রোযা রাখে। অপর
একটি হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে নবি পাক (সাঃ) এরশাদ করেছেন। শবে বরাতের রাত্রে
আল্লাহ তায়ালার আদেশ সত্তর হাজার ফেরেশতা পৃথিবীতে আগমন করে ইবাদতকারীদের সাথে
আন্তরিকভাবে আলিঙ্গন করতে থাকে এবং তারা আমলনাময় সোয়াব লিখতে থাকেন যে পর্যন্ত
না কিয়ামত হয়।
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদিগণকে ডেকে বলবেন "হে ফেরেশতাগণ তোমরা
আমার (ইবাদতকারী) বান্দাদের আমলনামা লিখা বন্ধ কর। এখন আমি তাদেরকে বিনা হিসেবে
জান্নাতে দাখিল করব। জেনে রাখো তোমরা তাদের পূণ্য লিখে শেষ করতে পারবে না কেবল
তোমরাই নয় আসমান ও জমিনের সমস্ত ফেরেশতা একত্রিত হয়েও তাদের করতে পারবে না।
শবে বরাতের রাত্রিতে আল্লাহ ইবাদতকারী আলেম, ফাযেল, অলি, দরবেশ, গাউস, কুতুব, শহীদ এবং পাপি-তাপি সকল ঈমানদারকে মার্জনা করে দেবেন। তবে জাদুকর, গণক, বখিল, মদ পানকারী, জিনাকার নেশাকার এবং পিতা-মাতাকে কষ্টদানকারীগণকে মার্জনা করবেন না। যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নিকট খালেছ নিয়তে তওবা করবে। কেননা হযরত নবী করিম (সাঃ) এই রাতে যাহারা ইবাদত বন্দেগী করবেন আল্লাহ তায়ালা নিকট তাদের গোনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করবেন। তাদের গুনা পাহাড় বরাবর হলেও আল্লাহ পাক মার্জনা করে দেবেন। শা'বান মাসের ১৫তারিখ রাত্রে বনু কেলাব, বনু নজির ও বনু রবী এই তিন বংশের পালিত ভেড়া ও বকরীর পশমের সমতুল্য আমার অগণিত পাপে উম্মতকে মার্জনা করে দেওয়া হবে। কথিত আছে যে,এই প্রত্যেক বংশের ২০ হাজারের উর্ধ্বে ভেড়া বকরি ছিল।
শবে বরাতের নামাজ কত রাকাত
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে অর্থাৎ ১৫ তারিখ রাতে পালন করা হয় শবে
বরাত। এই রাত্রি ইবাদত বন্দেগির এবং নফল নামাজ আদায়ের মাধ্যমে কাটানো
অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ এবং সওয়াবের কাজ তবে এই পবিত্র রাতে নামাজ আদায়ের
ক্ষেত্রে কোন ধরা বাধা রাকাত সংখ্যা নেই। এই রাতে দুই রাকাত নফল
নামাজের নিয়তে যে যত বেশি সংখ্যক নামাজ আদায় করতে পারবে সে ততো সওয়াবের
অধিকারী হবে। তবে কোন কোন হাদিসের বইগুলো থেকে জানতে পারা যায় যে এ রাতে সর্বনিম্ন ১২ রাকাত নামাজ আদায় করা উচিত।
শবে বরাতের নামাজ নফল নাকি সুন্নত
শবে বরাতের নামাজ সুন্নত নাকি নফল এ সম্পর্কে অনেকেই দ্বিধাদন্দে ভোগেন।অনেকে
মনে করেন এই নামাজ সুন্নত কিন্তু এ ধারনাটি একেবারেই ভূল, শবে বরাতের নামাজ হলো
নফল।
শবে বরাতের নফল ইবাদত
এই রাত্রে নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, তসবীহ তাহলীল, দোয়া-দরুদ পাঠ করা অত্যন্ত
ফজিলত ও বরকতময়। বেশকিছু ধর্মীয় বই পুস্তকের মাধ্যমে জানতে পারা যায় যে, এ
রাত্রে (সন্ধ্যার সময়) গোসল করা অতি পুণ্যের কাজ। এ রাত্রের এশার নামাজ আদায় করে
লাইলাতুল বরাত নফল নামাজের নিয়তে যথাসাধ্য বেশি পরিমাণ নামাজ পড়বে। ধরা বাঁধা
রাকাতের পরিমাণ নেই। তবে যত বেশি পড়িবে ততই বেশি সওয়াব লেখা হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে
আমরা যেমন বেশি বেশি লাভের প্রচেষ্টা করে থাকি।, তেমনি পরকালে সুখ-শান্তিতে থাকার
জন্যও বেশি বেশি করে নফল ইবাদত করা আমাদের উচিত।
১. নবী পাক (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি শবে বরাতে আমার ওপর ১০০ বার দুরুদ
শরীফ পাঠ করবে। হাশরের দিন আমি তাকে সকলের আগে শাফায়েত করব।
২. ইবাদতের নিয়তে যে ব্যক্তি শবে বরাতের সন্ধ্যা কালে উত্তমরূপে গোসল করবে, তার
গোসলের প্রতি ফোটা পানির বিনিময়ে ৭০০ রাকাত নফল নামাজ পূণ্য লাভে ধন্য
হবে।
৩. এ রাতে দুই দুই রাকাত করে নফল নামাজের নিয়তে যে ব্যক্তি ১২ রাকাত নামাজে
প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা ইখলাস ১৫ বার করে পাঠ করে সে বিশেষ সওয়াবের
অধিকারী হবে।
৪. হাদীস শরীফের অন্য এক বর্ণনায় আছে, দ্বীনের নবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন যে
ব্যক্তি শা'বান মাসের ১৫ তারিখ দিনে আমার ওপর ১০০ বার দুরুদ শরীফ পাঠ করবে আর
রাত্রেও একশতবার দুরুদ শরীফ পাঠ করবে, দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে
দাখিল করবেন এবং দোযখের আগুন তার জন্য হারাম হয়ে যাবে। শবে বরাতের নামাজ নফল এবং
দুই দুই রাকাত করে পড়ায় সর্বোত্তম। এক নিয়তে নফল নামাজ রাতে আট রাকাত এবং দিনে
৬ রাকাত করে পড়ার বিধান কেতাবে আছে।
মন্তব্য , আশা করি শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে আপনারা সবাই ভালোভাবে
জেনেছেন, যেহেতু রএ রাতের ফজিলত অনেক বেশি তাই সবাই চেষ্টা করবেন অবহেলা না করে
ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে পবিত্র এ রাতটি উৎযাপন করার।
নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন
comment url